16 June, 2025

ইতযা ভাল্ভুল সমস্যাগুলি কি করে হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়? | ডঃ ধমোদরন কার্ডিওলজিস্ট

হার্টের স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা আজকের দিনে অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে হার্টের ভাল্ভুল অর্থাৎ হৃদযন্ত্রের ভালভের সমস্যা হলে তা যে কিভাবে মারাত্মক হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগের কারণ হতে পারে, তা সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডঃ ধমোদরন, একজন অভিজ্ঞ কার্ডিওলজিস্ট, এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই লেখায় আমরা হার্টের ভালভের সমস্যা, তার লক্ষণ, ঝুঁকি এবং চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করব।

 

বিষয়বস্তু তালিকা

হার্টের ভালভ কি এবং এর গুরুত্ব

হার্টের ভালভগুলো হল এমন বিশেষ গঠন যা রক্ত প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। হৃদপিণ্ডের চারটি ভালভ রয়েছে: মাইট্রাল, ট্রাইকাস্পিড, অ্যোর্টিক এবং পালমোনারি ভালভ। এই ভালভগুলো রক্তের সঠিক গতি নিশ্চিত করে, যাতে রক্ত হার্টের বিভিন্ন কক্ষ থেকে সঠিকভাবে প্রবাহিত হয়। যদি এই ভালভগুলোর কোন সমস্যা হয়, যেমন ভালভ সংকীর্ণ হওয়া (স্টেনোসিস) বা ভালভ ঠিকমতো বন্ধ না হওয়া (রেগারজিটেশন), তাহলে রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, যা হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।

হার্ট ভালভের সমস্যার ধরণ এবং লক্ষণ

হার্ট ভালভের প্রধান দুই ধরনের সমস্যা হল:

  • স্টেনোসিস (Stenosis): ভালভ সংকীর্ণ হয়ে রক্ত প্রবাহ সীমিত করে।
  • রেগারজিটেশন (Regurgitation): ভালভ ঠিকমতো বন্ধ না হওয়ার কারণে রক্ত পিছিয়ে আসে।

এই সমস্যাগুলোর লক্ষণগুলি প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক সময় খুবই হালকা বা স্পষ্ট হয় না। অনেক রোগী তাদের সমস্যার কথা জানতেও পারেন না। কিন্তু ধীরে ধীরে দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড়ানো বা ব্যথা, ক্লান্তি এবং পা ফোলা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

সাইলেন্ট বা গোপন সমস্যা

হার্ট ভালভের সমস্যাগুলো অনেক সময় সাইলেন্ট বা গোপন থাকে, অর্থাৎ রোগীর কোনো স্পষ্ট লক্ষণ দেখা দেয় না। এই কারণে অনেক সময় রোগীরা সমস্যাটি বুঝতে পারেন না এবং সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ার ফলে হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলিওরের মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে।

হার্ট ভালভের সমস্যা কি করে হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়?

হার্ট ভালভের সমস্যা হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। যখন ভালভ ঠিকমতো কাজ করে না, তখন হৃদপিণ্ডকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় রক্ত সঠিকভাবে পাম্প করার জন্য। দীর্ঘ সময় ধরে এই অতিরিক্ত চাপ হৃদপিণ্ডের পেশী দুর্বল করে দেয় এবং হার্ট ফেইলিওরের ঝুঁকি বাড়ায়।

এই অবস্থায় রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে হৃদপিণ্ডের রক্ত সরবরাহকারী ধমনীতে ব্লক বা সংকোচন হতে পারে, যা হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়। এছাড়া ভালভের সমস্যা থাকলে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা হার্ট অ্যাটাকে প্রভাব ফেলে।

হার্ট ভালভের সমস্যার ঝুঁকি নির্ণয় এবং পরীক্ষা পদ্ধতি

হার্ট ভালভের সমস্যার ঝুঁকি নির্ণয়ের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • ১২৮-স্লাইস সিটি স্ক্যান (128 Slice CT Scan): এই অত্যাধুনিক স্ক্যান হার্টের ভালভ এবং ধমনী ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে।
  • ইকোকার্ডিওগ্রাফি (Echocardiography): হৃদযন্ত্রের ভালভের গঠন ও কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়।
  • রক্ত পরীক্ষা ও অন্যান্য শারীরিক পরীক্ষা: রোগীর প্রোফাইল ও ঝুঁকি নির্ণয় করতে ব্যবহৃত হয়।

বিশেষত যারা ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো ঝুঁকিপূর্ণ রোগে ভুগছেন, তাদের নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত কারণ তারা হার্ট ভালভের সমস্যার জন্য বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।

হার্ট ভালভের সমস্যার চিকিৎসা পদ্ধতি

হার্ট ভালভের সমস্যার চিকিৎসা মূলত রোগের ধরণ, রোগীর বয়স, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত অবস্থার উপর নির্ভর করে। প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো হল:

১. ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা

প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু ক্ষেত্রে ওষুধের মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যেমন রক্তচাপ কমানো, হার্টের অতিরিক্ত চাপ কমানো ইত্যাদি। তবে শুধুমাত্র ওষুধ দিয়ে ভালভের গঠনগত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

২. সার্জারি বা অপারেশন

পুরোনো এবং প্রচলিত পদ্ধতি হিসেবে হার্টের ভালভের অপারেশন বা প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে এই পদ্ধতিতে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে:

  • অপারেশনটি বেশ জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল নির্ভর করে রোগীর অবস্থার উপর।
  • বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে এবং যাদের অন্যান্য সহ-রোগ রয়েছে, তারা অপারেশনের জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারেন।
  • অপারেশনের পরে কিছু জটিলতা যেমন সংক্রমণ, রক্তক্ষরণ ইত্যাদি হতে পারে।

৩. ট্রান্সক্যাথেটার ভালভ রিপ্লেসমেন্ট (TAVR)

সম্প্রতি হার্ট ভালভের চিকিৎসায় একটি নতুন এবং কম আক্রমণাত্মক পদ্ধতি এসেছে, যা ট্রান্সক্যাথেটার ভালভ রিপ্লেসমেন্ট বা TAVR নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে খোলা সার্জারি ছাড়াই একটি বিশেষ ক্যাথেটারের মাধ্যমে ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়।

এই পদ্ধতির সুবিধা:

  • বয়স্ক এবং সার্জারির জন্য অনুপযুক্ত রোগীদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।
  • রোগীর জীবনমান উন্নত করা এবং বাঁচার সম্ভাবনা বাড়ানো।
  • অপারেশনের ঝুঁকি কম এবং দ্রুত পুনরুদ্ধার।

বয়সভিত্তিক চিকিৎসা পরিকল্পনা

হার্ট ভালভের সমস্যায় রোগীর বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত:

  • ৬৫ থেকে ৮০ বছর বয়সের রোগী: এই বয়সের রোগীদের জন্য TAVR একটি ভালো বিকল্প হতে পারে, বিশেষ করে যারা খোলা সার্জারির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
  • ৮০ বছরের বেশি বয়সের রোগী: এই গোষ্ঠীর রোগীদের ক্ষেত্রে খোলা সার্জারি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, তাই TAVR বা অন্যান্য নন-ইনভেসিভ পদ্ধতি প্রাধান্য পায়।

সঠিক চিকিৎসার জন্য দলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ

হার্ট ভালভের রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা একটি জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে কার্ডিওলজিস্ট, সার্জন এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুসমন্বয় প্রয়োজন। রোগীর সর্বোত্তম স্বার্থে একটি দলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, যাতে রোগীর শারীরিক অবস্থা, ঝুঁকি এবং চিকিৎসার সম্ভাব্য ফলাফল বিবেচনা করা হয়।

হার্ট ভালভের সমস্যা প্রতিরোধে করণীয়

হার্ট ভালভের সমস্যা প্রতিরোধের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেনে চলা উচিত:

  1. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হার্টের পারিবারিক ইতিহাস আছে তাদের নিয়মিত কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
  2. স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন: সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ হার্টের সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।
  3. ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার: এগুলো হার্টের জন্য ক্ষতিকর এবং ভালভের সমস্যা বাড়াতে পারে।
  4. মেডিকেশন নিয়মিত গ্রহণ: ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সঠিকভাবে গ্রহণ করা।
  5. মিথ্যা তথ্য থেকে সতর্কতা: সোশ্যাল মিডিয়া বা অন্য কোথাও থেকে আসা ভুল তথ্য থেকে দূরে থাকা এবং শুধুমাত্র বিশ্বাসযোগ্য চিকিৎসা উৎস থেকে তথ্য গ্রহণ করা।

হার্ট ভালভ রোগীদের জন্য জীবনযাত্রার পরামর্শ

যারা হার্ট ভালভের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য কিছু জীবনযাত্রার পরামর্শ:

  • অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম এড়ানো।
  • স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করা।
  • ডাক্তারের নিয়মিত পরিদর্শন নিশ্চিত করা।
  • সঠিক ওষুধ গ্রহণ এবং কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে তা দ্রুত জানান।
  • যদি শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড়ানো বা অন্য কোনো গুরুতর লক্ষণ দেখা দেয়, দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া।

উপসংহার

হার্ট ভালভের সমস্যা যে হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে, এটি সত্যিই একটি গুরুতর বিষয়। প্রাথমিক পর্যায়ে হালকা লক্ষণ থাকলেও তা অবহেলা করলে জীবন বিপন্ন হতে পারে। তাই হার্টের ভালভের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হওয়া, নিয়মিত পরীক্ষা করানো এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

ডঃ ধমোদরন কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী, আধুনিক প্রযুক্তি এবং উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব এবং রোগীর জীবনমান ও আয়ু উন্নত করা যায়। তাই সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা উচিত।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

১. হার্ট ভালভের সমস্যা কি সবসময়ই লক্ষণ দিয়ে থাকে?

না, অনেক সময় হার্ট ভালভের সমস্যা সাইলেন্ট বা গোপন থাকে এবং স্পষ্ট লক্ষণ দেখা দেয় না। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি।

২. হার্ট ভালভের সমস্যার প্রধান কারণ কী?

বয়সসন্ধিকাল, রিউম্যাটিক ফিভার, সংক্রমণ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং পারিবারিক ইতিহাস হার্ট ভালভের সমস্যার প্রধান কারণ হতে পারে।

৩. TAVR কি এবং এটি কাদের জন্য উপযোগী?

TAVR বা ট্রান্সক্যাথেটার ভালভ রিপ্লেসমেন্ট একটি কম আক্রমণাত্মক পদ্ধতি, যা বিশেষত বয়স্ক এবং খোলা সার্জারির জন্য উপযুক্ত নয় এমন রোগীদের জন্য উপযোগী।

৪. হার্ট ভালভের সমস্যা প্রতিরোধে কী করণীয়?

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা উচিত।

৫. হার্ট ভালভের সমস্যার চিকিৎসায় খোলা সার্জারি ছাড়া অন্য বিকল্প কি আছে?

হ্যাঁ, TAVR পদ্ধতি বর্তমানে একটি জনপ্রিয় বিকল্প, যা কম আক্রমণাত্মক এবং দ্রুত পুনরুদ্ধারের সুযোগ দেয়।

Share